সুখ

~~সুখ~~



শ্বশুর মশাই নিজের বাটি থেকে টুক করে একটা মাংসের টুকরো বৌমার পাতে দিয়ে দিলেন। বৌমা অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে বলে, 'এ কি করলেন বাবা? আপনিই খান। সারাদিন আপনার যা পরিশ্রম'! মাংসের টুকরোটি ফেরত দেওয়ার জন্য সে জেদাজেদি করতে থাকে। 

শ্বশুর মশাই অর্ধেন্দু বিশ্বাস তৃপ্ত মনে বৌমাকে বলেন, 'মা, আজ আমি খুব খুশি হয়েছি'।

বৌমা লিপা কৌতুহলী হয়ে জানতে চায়, 'কেন বাবা? কি হয়েছে'?'

অর্ধেন্দু বাবুর একটি বই বাঁধাইয়ের দোকান রয়েছে। বই বাঁধাইয়ে খুব নাম-ডাক তাঁর। অঢেল কাজ। বাড়ির সঙ্গেই দোকান। বাড়ির মধ্যেই রয়েছে আরও দুটি রুম। সংকীর্ণ জায়গা। বাড়ির চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ডাঁই করা বই। একটি রুমে থাকেন লিপার শ্বশুর ও শাশুড়ী। আরেকটি রুমে লিপা ও তাঁর স্বামী। এছাড়াও রয়েছে এক অবিবাহিত ননদ। ননদটি কখনো বাবা মায়ের রুমে, কখনো সিঁড়ির নিচে থাকে। রাস্তার ধারের রুমটায় সারাদিন বই বাঁধাইয়ের কাজ করেন অর্ধেন্দু বাবু। ছেলেও হাত লাগান কাজে। লিপার বয়স অল্প। উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর সদ্য বিয়ে হয়েছে। শ্বশুর মশাইয়ের অনুপ্রেরণায় পড়াশোনা চালিয়ে যায় লিপা। কলেজে ভর্তি হয়েছে ম্যাথেমেটিক্স অনার্স নিয়ে।  পড়াশোনা সেরে লিপা আজ শ্বশুর মশাইয়ের বই সেলাইয়ের কাজে হাত লাগিয়েছিল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পছন্দের বই গুলো একটু একটু করে পড়েও নিচ্ছিল। সেই দেখে শ্বশুর মশাই আজ খুব খুশি। সেই সূত্র ধরে শ্বশুর মশাই বৌমার প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'আজ আমি খুব খুশি। নতুন বিয়ে হয়েছে। এইটুকু একটা মেয়ে! সব জড়তা ছেড়ে আজ তুমি বই বাঁধাইয়ের কাজ করলে। তোমারই সংসার। এইভাবেই সংসারটাকে আগলে রেখো মা'।

এতক্ষণ শাশুড়ী মা চুপ করে ছিল। তিনি এবার অভিমানী সুরে বললেন, 'আমি কেউ নই বুঝি! এতো বছর রেঁধে বেড়ে খাওয়ালাম যে!'

শ্বশুর মশাই খুনসুটি করে বললেন, 'হুম, তাই উনি শুধু রান্না ঘরটাই চেনেন, বই বাঁধাই ঘরটা চিনতেই পারলেন না'!

সবাই হা হা করে হেসে উঠলো। খাওয়া শেষে সকলের বিছানা রেডি করে দিয়ে লিপা গেল ননদের কাছে। তাঁর কয়েকটা ম্যাথের প্রবলেম সলভ করে দিয়ে লিপা বললো, 'চল, এখন একটু লুডো খেলি'।

ননদ তো আনন্দে এক পায়ে খাড়া। লুডোর আসরে একে একে যোগ দিল লিপার শ্বশুর ও স্বামী। ওদিকে লিপার শাশুড়ী এক কোনে বসে ঘনঘন হাই তুলছে।

লিপার শ্বশুর মশাই শাশুড়ীকে বললেন, 'ওগো শুনছো! ঘুমিয়ে পড়ো যাও! আগামীকাল ভোর ভোর উঠতে হবে'।

লিপা কৌতুহলী হয়ে জানতে চায়, 'কেন? ভোরে উঠবে কেন'?

শশুর মশাই বললেন, 'একটা সারপ্রাইজ আছে'।

সবাই চুপ। সবাই ভাবছে, কি সারপ্রাইজ! লিপা জিদ ধরলো, 'আর টেনশন নিতে পারছি না। বলেই দাও না বাবা'।

শশুর মশাই বললেন, 'আগামীকাল সকাল সকাল  আমরা সবাই মিলে মহিষাদল রথের মেলা যাবো'।

আনন্দে নেচে উঠলো লিপা। ননদ গিয়ে জড়িয়ে ধরলো বৌদিকে। লিপা আনন্দে বললো, 'বাবা, আমি ফুচকা খাবো'। 

শ্বশুর মশাই আবেগ প্রবন হয়ে বললেন, 'আচ্ছা, আচ্ছা মা! যা খাবে তাই খাওয়াবো'।

এরপর প্রত্যেকেই দ্রুত বিছানায় চলে গেলো।


এরপর মাঝে কেটে গেল দশটা বছর। শ্বশুর মশাই মারা গেছেন ইতিমধ্যে। যুগের পরিবর্তনে ডিজিটাল মিডিয়ার আগ্রাসনে ছাপা বইয়ের জনপ্রিয়তাও কমেছে। ফলে বই বাঁধাইয়ের দোকানটাও বন্ধ হয়ে গেল। বছর পাঁচেক হল লিপা একটি হাইস্কুলে চাকরি পেয়েছে। লিপার একটি সন্তানও হয়েছে। স্বামী একটা ছোট কোম্পানিতে কাজ করে এখন। ননদ বিয়ে করে চলে গেছে। শাশুড়ী মাতা আধ্যাত্মিক জগতে নিজেকে বন্দী করেছেন। সেই ছোট্ট একতলা বাড়িটা আজ আরও আধুনিক হয়েছে। সেটি এখন তিনতলা। ফ্লোরে মার্বেল দেওয়া। বাথরুম, কিচেন সবই আধুনিক। 

এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় লিপা বাড়ির তিনতলায় একটি ঘরে এ সি চালিয়ে একাকী বসে আছে। এমনিতেই সময় কাটছে না লিপার। তার উপর একটু আগেই একটা ছোট বিষয় নিয়ে স্বামীর সাথে প্রবল ঝগড়া হয়েছে। স্বামী রাগ করে বেরিয়ে গেছেন বাজারে। ছেলে এক তলার একটি রুমে পড়াশোনা করছে। শাশুড়ী মাতা একটি অন্ধকার ঘরে ধ্যান করছেন। লিপার হঠাৎ চোখ পড়লো দেওয়ালে টাঙানো শ্বশুর মশাইয়ের ফটোটার দিকে। পরম যত্নে ফটোটা নামালেন লিপা। তাঁর চোখে জল। ফটোটা ভালো করে মুছে বিড়বিড় করে রুদ্ধ কন্ঠে লিপা বললো, 'বাবা, আগে ছোট ঘর ছিল। অনেক মানুষ ছিল। থাকার জায়গা ছিল না। কিন্ত অনেক আনন্দ ছিল। জীবনে সুখ ছিল। আর আজ অনেক বড় ঘর হয়েছে। মানুষের সংখ্যা কমে গেছে। থাকার জায়গারও অভাব নেই। কিন্তু আজ আর আনন্দ নেই। জীবনে সুখ নেই'।


সুখ © রূপেশ কুমার সামন্ত


***ছবিতে আজলদীঘী লাল আমন চাল এর খুদের ভাত আর বাড়ির কবুতর এর দুইপিস মাংস 🙂

No comments:

Post a Comment